সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য। আমরা তাঁর প্রশংসা করি, তাঁর সাহায্য ও ক্ষমা প্রার্থনা করি। আমরা আমাদের নিজেদের মন্দ এবং আমাদের খারাপ কাজের অনিষ্ট থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাই। যাকে আল্লাহ পথ দেখান, সে প্রকৃতপক্ষে সঠিক পথে আছে, এবং যাকে আল্লাহ পথহারা হতে দেন, তাকে কেউ পথ দেখাতে পারে না। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, তাঁর কোনো অংশীদার নেই এবং আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ ﷺ তাঁর রাসূল।
হে আল্লাহ! আমাদের নেতা মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর ওপর শান্তি, বরকত ও সালাম বর্ষণ করুন, যিনি নিরক্ষর নবী, এবং তাঁর পরিবারবর্গের ওপরও।
بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ
আল্লাহর নামে, পরম দয়ালু, অসীম দয়াবান
১. সূরাহ্ আল-বাক্বারাহ (২:১২৭)
رَبَّنَا تَقَبَّلْ مِنَّا إِنَّكَ أَنتَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ "হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের পক্ষ থেকে (এটি) গ্রহণ করো। নিশ্চয়ই তুমি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।"
🔹প্রেক্ষাপট:
আল্লাহর নির্দেশে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) তাঁর স্ত্রী হাজেরা ও শিশু ইসমাঈল (আঃ)-কে মক্কার বিরান মরুভুমিতে রেখে যান।
পরবর্তীতে, ইসমাঈল (আঃ) বড় হলে, আল্লাহর নির্দেশে তাঁরা কাবা ঘর নির্মাণ শুরু করেন।
কাবা নির্মাণ সম্পন্ন করার পর ইবরাহিম ও ইসমাইল (আঃ) আল্লাহর দরবারে এই দোয়া করেন।
🔹শিক্ষা:
কোনো ব্যক্তির শুধু কাজ করেই আত্মতৃপ্তি বোধ করা উচিত নয়। বরং, কাজের পর বিনয়ের সঙ্গে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা উচিত, যেন তিনি তা কবুল করেন।
ইবরাহিম (আ.)-এর দৃষ্টান্ত থেকে আমরা এটিই শিখি—তিনি কাবা নির্মাণের মতো এমন মহৎ কাজ সম্পন্ন করার পরও গর্ববোধ করেননি; বরং, বিনীতভাবে আল্লাহর কাছে আবেদন করেছেন যেন তিনি তাঁর এই আমলটি কবুল করে নেন।
২. সূরাহ্ আল-বাক্বারাহ (২:১২৮)
رَبَّنَا وَاجْعَلْنَا مُسْلِمَيْنِ لَكَ وَمِن ذُرِّيَّتِنَا أُمَّةً مُّسْلِمَةً لَّكَ وَأَرِنَا مَنَاسِكَنَا وَتُبْ عَلَيْنَا إِنَّكَ أَنتَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ "হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে তোমার অনুগত বান্দা করো এবং আমাদের বংশধরদের মধ্য থেকে একটি অনুগত সম্প্রদায় তৈরি করো। আমাদের ইবাদতের পদ্ধতি শিখিয়ে দাও এবং আমাদের তওবা কবুল করো। নিশ্চয়ই তুমি পরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।"
🔹প্রেক্ষাপট:
এটি ইবরাহিম (আ.)-এর দোয়া।
এই দোয়া তাঁর আল্লাহর প্রতি ভয় এবং আত্মসমর্পনের চূড়ান্ত পরিণতি।
তাই কাবা গৃহ নির্মানের কাজ সম্পাদনের পরে তিনি আজ্ঞাবহ ও বিনীত হৃদয়ে নিজের ও তাঁর ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্যও আনুগত্যের দোয়া করেছিলেন।
🔹শিক্ষা:
আমাদের আল্লাহর আনুগত্য লাভের জন্য এই দোয়া করা উচিত। কারণ আল্লাহর প্রতি প্রকৃত ভয় ও আনুগত্য বাড়ার সাথে সাথে মানুষের মধ্যে আরো বিনম্রতা ও আত্মসচেতনতা সৃষ্টি হয়।
আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দাদের তাদের সন্তানদের আত্মিক কল্যাণের বিষয়ে বিশেষভাবে চিন্তিত থাকা উচিত, বিশেষত পরকালের কল্যাণের জন্য। সন্তানদের জন্য দোয়া করার আরেকটি কারণ হলো, তারা যেন সৎ কর্মের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি ভালো দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে এবং মুসলিম জাতি সামগ্রিকবে উপকৃত হয়।
আল্লাহর প্রতি প্রকৃত ভয় ও আনুগত্য বাড়ার সাথে সাথে মানুষের মধ্যে আরো বিনম্রতা ও আত্মসচেতনতা সৃষ্টি হয়। তাই আল্লাহর আনুগত্য লাভের জন্য দোয়া করা উচিত।
সন্তানদের আত্মিক কল্যাণের বিষয়ে গভীরভাবে মননিবেশ করা প্রয়োজন, বিশেষত পরকালের কল্যাণের জন্য। আল্লাহ্র দরবারে দোয়া করি তারা যেন সৎ কর্মের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি ভালো দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে এবং মুসলিম জাতি সামগ্রিকবে উপকৃত হয়।
৩. সূরাহ্ আল-বাক্বারাহ (২:২০১)
رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ "হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে দুনিয়াতে কল্যাণ দাও, পরকালে কল্যাণ দাও এবং আমাদের জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা করো।"
🔹প্রেক্ষাপট:
এই দোয়াটির দুনিয়া ও আখিরাতের জন্য সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ দোয়াগুলোর একটি।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এই দোয়াটি অত্যন্ত বেশি পড়তেন।
বিশেষভাবে তাওয়াফের সময় পাঠ করার সুন্নাত।
আল্লামা বাগাভি (রঃ) বর্ণনা করেন, আনাস (রঃ) বলেন: একবার রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এক ব্যক্তিকে দেখলেন, যে এত বেশি রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েছিল যে তাকে ঠিক যেন ডিম থেকে সদ্য ফোঁটা এক পাখির ছানার মতো দেখাচ্ছিল। নবী (ﷺ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন: তুমি কি আল্লাহর কাছে দোয়া করো? সে উত্তর দিলো: হ্যাঁ, আমি এই দোয়া করতাম—“হে আল্লাহ! তুমি আমাকে আখিরাতে যে শাস্তি দেবে, তা এই দুনিয়াতেই দিয়ে দাও। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)বিস্ময়ে বললেন, “সুবহানাল্লাহ! তুমি কি এই শাস্তি সহ্য করার ক্ষমতা রাখো? কেন তুমি এই দোয়া করো না? (অর্থাৎ উপরের দোয়াটি)”। তখন সে দোয়াটি করলো, এবং সে সুস্থ হয়ে গেলো। (তাফসির মাজহারি - পৃষ্ঠা ৪০৩ - মুসলিম থেকে)
"দুনিয়ার কল্যাণ" বলতে কী বোঝায়?"
তাফসির ও হাদিস অনুযায়ী এই দোয়ার "দুনিয়ার কল্যাণ" মানে শুধু অর্থ-সম্পদ নয় বরং তা বিভিন্ন অর্থ বহন করে—
আলী (রঃ) বলেন, "এটি হলো একজন ধর্মপ্রাণ স্ত্রী।"
কাতাদাহ (রঃ) বলেন, "এটি শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন ও জীবিকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা।"
হাসান বসরি (রঃ) বলেন, "এটি ইসলামি জ্ঞান ও ইবাদত"
সুদ্দি (রঃ) বলেন, "এটি হালাল রিযিক।"
ইবনে উমর (রঃ) বলেন, "এটি নেক সন্তান ও মানুষের ভালোবাসা।"
জাফর (রঃ) বলেন, "এটি হলো সুস্থতা, সৎ জীবনযাপন, কুরআনের জ্ঞান, ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে বিজয় এবং নেককারদের সাহচর্য।"
🔹শিক্ষা:
দুনিয়ার জীবনের কল্যাণ কামনায় কোন দোষ নেই, কিন্তু আখিরাতের চিরস্থায়ী কল্যাণ পাবার যোগ্য ব্যক্তি কেবল সেই, যে দুনিয়ার কল্যাণের পাশাপাশি আখিরাতের কল্যাণেরও প্রত্যাশী হয়।
দুনিয়াতে আমরা যেন কেবল এমন কল্যাণেরই প্রত্যাশী হই যা আমাদের জন্য আখিরাতের সীমাহিন কল্যাণ অর্জনের পথকেও সুগম করবে।
দুনিয়ার জীবন ক্ষণস্থায়ী, আর আখিরাতের জীবনতো অনন্ত; আখিরাতের চিরস্থায়ী অকল্যান ও কঠিন শাস্তি থেকে বাচার জন্য আমাদের কামনা ও প্রচেষ্টাগুলো যেন কেবলই দুনিয়া কেন্দ্রিক না হয়।
"হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের উপর ধৈর্য ঢেলে দাও, আমাদের পদক্ষেপ দৃঢ় করো, এবং কাফিরদের বিরুদ্ধে আমাদের সাহায্য করো।"
🔹প্রেক্ষাপট:
তালুতের সেনারা সংখ্যায় অনেক কম ছিল এবং তাদের সামনে ছিল শক্তিশালী জালুতের বিশাল বাহিনী।
তবুও তাদের মধ্যকার ঈমানদারগণ ভয় পায়নি, বরং যুদ্ধ শুরুর আগে তারা আল্লাহর কাছে ধৈর্য, দৃঢ়তা ও বিজয়ের জন্য এই দোয়াটি করেছিলো।
🔹শিক্ষা:
ধৈর্যশীলদের উপর ধৈর্যের বিনিময়েই আল্লাহ তা'আলার সাহায্য এসে থাকে। বিজয় লাভ সৈন্যদের আধিক্যের উপর নির্ভর করে না। ইতিহাস তার বহু প্রমান বহন করছে যে, মুষ্টিমেয় কয়েকটি লোকে বিরাট দলকে পরাজিত করেছে।
তাই আল্লাহ্র রাস্তায় যে কোন কঠিন পরিস্থিতির মুকাবেলায় ধৈর্য ধারন ও সাবিত কদম থেকে আল্লাহর সাহায্য কামনা করতে হবে।
বিজয় ও সাফল্যের জন্য আল্লাহর ওপরই ভরসা রাখতে হবে।